শিষ্টাচার ও শিক্ষা || Etiquette and Education
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা জাপানের সংস্কৃতির একটি অংশ। শৈশব থেকেই শিশুদেরকে পরিচ্ছন্নতার শিক্ষা দেওয়া হয় সে-দেশে।
“পরিষ্কার না করে তারা কখনই জায়গা ছেড়ে যায় না। এটি তাদের প্রতিদিনের শিক্ষার একটি অংশ।”
২০১৮ সালে জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক স্কট নর্থ বিবিসিকে বলেছিলেন, জাপানিদের জীবনযাত্রায় গর্ব প্রদর্শনের একটি উপায় হল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা।
“ফুটবল ম্যাচের পরে গ্যালারি পরিষ্কার করার বিষয়টি বাচ্চাদের স্কুলেই শেখানো হয়, এটি তাদের শৈশবের প্রাথমিক আচরণেরই একটি সম্প্রসারিত রূপ। জাপানে বাচ্চারা তাদের স্কুলের ক্লাসরুম এবং হলওয়েও পরিষ্কার করে,” বলেন তিনি।
জাপানে একটি প্রবাদ আছে- ‘তাতসু তোরি আতো ও নিগোসাজু’, যার আক্ষরিক অর্থ অনেকটা এরকম- ‘যে পাখি উড়ে যায়, তার চলার পথকে সে কর্দমাক্ত (ময়লা) করে না’। জাপানের স্কুলগুলোতে শিশুকাল থেকেই বাচ্চাদের এই শিষ্টাচার শেখানো হয়।
কাতার বিশ্বকাপে শক্তিশালী দল জার্মানিকে ২-১ গোলে হারিয়ে আনন্দে ভাসছে জাপান। চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে আনন্দে ভাসলেও খেলা শেষে, স্টেডিয়াম ছাড়ার আগে আবর্জনা পরিষ্কার করতে ভোলেননি জাপানি সমর্থকরা। শুধু স্টেডিয়ামের গ্যালারিই নয়, ম্যাচ শেষে টিমের ড্রেসিংরুমও একেবারে চকচকে করে রেখে গেছেন জাপানিরা। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপের পর ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নজির গড়ে করে আরো একবার প্রশংসা কুড়ালেন তারা।
জাপানিদের এই সততা ও শিষ্টাচার আমাদের মুগ্ধ করে। কিন্তু মনে প্রশ্নও জাগায়- কেন জাপানের লোকজন এতটা কর্মঠ এবং সৎ….?
প্রফেসর ড. মার্ক ডি ওয়েস্ট বলেন, ‘জাপানিরা এই সততা দৈবগুণে পায়নি, তাদের আইন-শৃঙ্খলা যথেষ্ট শক্তিশালী। মানুষ আইন মেনে চলতে বাধ্য। কিন্তু তবুও এটাই একমাত্র কারণ নয়। জাপানিরা উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু একটা পায়, যা তারা মনে প্রাণে ধারণ করে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।’
কিন্তু কি সেই রহস্যময় সূত্র যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বপন করে চলছে জাপানিরা.?
১। পুলিশ যখন বন্ধু -“জাপানি কাবান”ঃ
জাপানের মহল্লাগুলোয় কিছুদূর পরপরই ছোট ছোট পুলিশ স্টেশন আছে। এই স্টেশনগুলোকে বলা হয় কাবান। এখানকার পুলিশরা রীতিমতো বন্ধুর মতো আগলে রাখে মহল্লাবাসীকে। মজার উদাহরণ দিই, এলাকায় কোন বয়স্ক বাসিন্দার খোঁজ নিতে হলে তাদের আশেপাশের প্রতিবেশীর বাড়ি যান অফিসাররা। জিজ্ঞেস করেন,”পাশের বাড়ির মুরুব্বিরা কেমন আছেন? খবর রাখেন তাদের?” এভাবেই তরুণ প্রজন্মদের মধ্যে বয়স্কদের প্রতি দায়িত্বশীলতার চর্চা ছড়িয়ে দিতে কাজ করেন তারা।
শুধু তাই নয়, বাচ্চারা যেন বয়স্কদের প্রতি খেয়াল রাখে, রাস্তা পার হতে সহায়তা করে, বাড়ি এগিয়ে দেয় এসমস্ত বিষয়েও উদ্বুদ্ধ করেন অফিসাররা।
২। বুদ্ধের শিক্ষাঃ
জাপানিদের এই সততা ঠিক ধর্ম ভীতি থেকে আসেনি। কিন্তু তবু তাদের অনেকেই ‘শিন্তো’ রীতির চর্চা করেন। এই রীতি অনুসারে মৃত্যুর পরে পুনরুত্থান হবে মানুষ। কিন্তু তারাই পুনর্জীবন লাভ করবে যাদের হৃদয় শুদ্ধ আর কর্ম সৎ। পারিবারিকভাবে এই রীতির চর্চাও সততা আর দায়িত্বশীলতা তৈরি করে।
৩। পারিবারিক বন্ধনঃ
জাপানিরা ছোটবেলা থেকেই দৃঢ় পারিবারিক বন্ধনের মধ্যে বড় হয়। এখনও জাপানে কেউ অসুস্থ হলে রোগীকে নয়, বরং তার পরিবারের সদস্যদেরকে রোগের কথা জানান ডাক্তার। কেননা তারা মনে করেন পরিবারের সদস্যদের আদর আর ভালোবাসাই সবচেয়ে বেশি দরকার। মানুষকে যেকোনো বিপদে শক্ত থাকার প্রেরণা যোগায়।
আর এই পারিবারিক বন্ধনই জাপানিদের পরিবার, সমাজ আর মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলে।
৪। ‘হিতো নো মিঃ
২০১১ সালে জাপানে সুনামির আঘাতে পারমাণবিক চুল্লি ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে তেজষ্ক্রিয়প্রবণ এলাকাগুলো থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয় মানুষকে। এসময় পাড়া-মহল্লাগুলো একেবারে বিরান পড়েছিল। ছিল না পাহারা দেওয়ার মতো কেউ। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার- মাসখানেক পর এসে দেখা গেল জিনিসপত্র যেভাবে রেখে যাওয়া হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই রয়ে গেছে সব, কারও কোনো কিছু খোয়া যায়নি, চুরি যায়নি!
কিভাবে সম্ভব হলো এটা? সাধারণত যখন দেখার কেউ থাকে না, মানুষের অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। কিন্তু জাপানে এরকমটা হয় না। এর কারণ ‘হিতো নো মি’, যার মানে হলো ‘সমাজের চোখ’। প্রতিটি সমাজের একটা সত্ত্বা আছে, যাকে তিল তিল করে তৈরি করি আমরা। কেউ না দেখলেও সমাজের এই চোখ দেখছে বলেই বিশ্বাস করেন জাপানিরা।
৫। আমি নই, আমরাঃ
হ্যাঁ, এটাই তাদের শক্তি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদে নয়, বরং যৌথ সত্ত্বায় বিশ্বাস করেন তারা। এভাবেই শুধু নিজের জন্য নয়, পুরো সমাজের জন্য চিন্তার চর্চা করেন জাপানিরা
এক জরিপে দেখা গেছে, অধিকাংশ জাপানি মা-ই চান, তাদের সন্তান একটি সাধারণ জীবন যাপন করুক। খুব উচ্চাভিলাষী, সমাজ বিচ্ছিন্ন জীবনে তারা অভ্যস্ত হোক, এটা তারা একেবারেই চান না। এর কারণ, জাপানী মায়েরা মনে করেনঃ
একসঙ্গে থাকার শক্তিই মানুষকে বড় করে। মানুষকে উদার আর দয়াশীল করে। আর আজকের পৃথিবীতে এটাই সবচাইতে বেশি দরকার আমাদের।
( 𝑻𝒉𝒆 𝒑𝒐𝒘𝒆𝒓 𝒐𝒇 𝒃𝒆𝒊𝒏𝒈 𝒕𝒐𝒈𝒆𝒕𝒉𝒆𝒓 𝒊𝒔 𝒘𝒉𝒂𝒕 𝒎𝒂𝒌𝒆𝒔 𝒑𝒆𝒐𝒑𝒍𝒆 𝒈𝒓𝒐𝒘. 𝑴𝒂𝒌𝒆𝒔 𝒑𝒆𝒐𝒑𝒍𝒆 𝒈𝒆𝒏𝒆𝒓𝒐𝒖𝒔 𝒂𝒏𝒅 𝒌𝒊𝒏𝒅. 𝑨𝒏𝒅 𝒕𝒉𝒊𝒔 𝒊𝒔 𝒘𝒉𝒂𝒕 𝒘𝒆 𝒏𝒆𝒆𝒅 𝒎𝒐𝒔𝒕 𝒊𝒏 𝒕𝒐𝒅𝒂𝒚’𝒔 𝒘𝒐𝒓𝒍𝒅.)
সকল তথ্য সংগ্রহীত [ All information collected ]